প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস
১. সিন্ধু সভ্যতা (২৬০০–১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব)
বিস্তারিত বিবরণ:
সিন্ধু সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জ যুগের একটি উন্নত নগর সভ্যতা, যা বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
নগর পরিকল্পনা:
গ্রিড পদ্ধতি: রাস্তাগুলো সমকোণে পরস্পরকে ছেদ করতো।
নিকাশি ব্যবস্থা: প্রতিটি বাড়িতে স্নানাগার ও নিকাশি নালি ছিল।
উদাহরণ: মহেঞ্জোদারোর "গ্রেট বাথ" (বৃহৎ স্নানাগার)।
অর্থনীতি:
কৃষি: গম, যব, তুলা চাষ।
বাণিজ্য: মেসোপটেমিয়ার সাথে পাথর, ধাতু ও মুক্তার বাণিজ্য।
মুদ্রা: ব্যার্টার সিস্টেম (মুদ্রার ব্যবহার ছিল না)।
ধর্ম ও সংস্কৃতি:
প্রোটো-শিব: পশুপতি শিবের মোহর।
মাতৃদেবী: উর্বরতার প্রতীক।
সমাধি পদ্ধতি: কবরস্থানে মৃতদেহ সমাহিত করা হতো।
পতনের কারণ:
প্রাকৃতিক কারণ:
সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া।
ভূমিকম্প ও বন্যা।
মানবসৃষ্ট কারণ:
আর্যদের আক্রমণ (ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কিত)।
বাণিজ্যপথের পরিবর্তন।
২. বৈদিক সভ্যতা (১৫০০–৫০০ খ্রিস্টপূর্ব)
দুটি প্রধান পর্যায়:
ঋগ্বৈদিক যুগ (১৫০০–১০০০ খ্রিস্টপূর্ব):
ভৌগোলিক বিস্তার: সপ্তসিন্ধু অঞ্চল (পাঞ্জাব ও হরিয়ানা)।
সমাজ:
গোত্র ব্যবস্থা: রাজন (গোত্রপ্রধান) ও পুজন (পুরোহিত)।
বর্ণপ্রথা: পরে বিকশিত হয় (প্রাথমিকভাবে পেশাভিত্তিক বিভাজন)।
ধর্ম:
প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা (ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ)।
যজ্ঞের প্রচলন।
পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০–৫০০ খ্রিস্টপূর্ব):
ভৌগোলিক বিস্তার: গাঙ্গেয় সমভূমি (উত্তরপ্রদেশ, বিহার)।
রাজনীতি:
জনপদ গঠন: ক্ষেত্রীয় রাজ্যের উত্থান।
রাজ্যাভিষেক: রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ।
ধর্ম:
উপনিষদ: আত্মা ও ব্রহ্মের ধারণা।
পুরাণ: রামায়ণ ও মহাভারতের সূচনা।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
বর্ণপ্রথার বিকাশ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
শিক্ষা: গুরুকুল শিক্ষা পদ্ধতি।
৩. ষোড়শ মহাজনপদ (৬ষ্ঠ শতক খ্রিস্টপূর্ব)
প্রধান মহাজনপদ ও তাদের বৈশিষ্ট্য:
মহাজনপদ | রাজধানী | গুরুত্ব |
---|---|---|
মগধ | রাজগৃহ/পাটলিপুত্র | সর্বশক্তিশালী (বিম্বিসার, অজাতশত্রু) |
কোশল | অযোধ্যা | রামায়ণের পটভূমি |
বৎস | কৌশাম্বী | উদয়ন রাজার রাজ্য |
অবন্তী | উজ্জয়িনী | বাণিজ্যিক কেন্দ্র |
মগধের উত্থানের কারণ:
কৃষি সম্পদ: গাঙ্গেয় সমভূমির উর্বর জমি।
সামরিক শক্তি: হস্তী বাহিনী ও লৌহ অস্ত্র।
কূটনীতি: বিম্বিসারের বৈবাহিক জোট।
৪. বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম
গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩–৪৮৩ খ্রিস্টপূর্ব):
মূল শিক্ষা:
চার আর্যসত্য:
দুঃখের অস্তিত্ব।
দুঃখের কারণ (তৃষ্ণা)।
দুঃখের নিবৃত্তি।
দুঃখ নিবৃত্তির পথ (অষ্টাঙ্গিক মার্গ)।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ:
সম্যক দৃষ্টি, সংকল্প, বাক্য, কর্ম, জীবিকা, প্রচেষ্টা, স্মৃতি, সমাধি।
ধর্ম প্রচার:
প্রথম উপদেশ: সারনাথে (ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র)।
বৌদ্ধ সংগীতি: রাজগৃহ, বৈশালী, পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত।
মহাবীর (৫৪০–৪৬৮ খ্রিস্টপূর্ব):
মূল শিক্ষা:
তিন রত্ন:
সম্যক দর্শন (সঠিক বিশ্বাস)।
সম্যক জ্ঞান (সঠিক জ্ঞান)।
সম্যক চরিত্র (সঠিক আচরণ)।
পঞ্চ মহাব্রত:
অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
বৈশিষ্ট্য | বৌদ্ধ ধর্ম | জৈন ধর্ম |
---|---|---|
অহিংসা | গুরুত্বপূর্ণ | সর্বোচ্চ গুরুত্ব |
ঈশ্বর | নিরীশ্বরবাদ | নিরীশ্বরবাদ |
বর্ণপ্রথা | প্রত্যাখ্যান | আংশিক স্বীকার |
৫. মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২২–১৮৫ খ্রিস্টপূর্ব)
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২২–২৯৮ খ্রিস্টপূর্ব):
রাজ্য বিস্তার: সেলুকাস নিকেটরকে পরাজিত করে গান্ধার অঞ্চল লাভ।
প্রশাসন:
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক কৌশল।
প্রাদেশিক শাসন: স্থানীয় রাজ্যপালদের নিয়োগ।
অশোক (২৬৮–২৩২ খ্রিস্টপূর্ব):
কলিঙ্গ যুদ্ধ (২৬১ খ্রিস্টপূর্ব):
রক্তপাত দেখে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ।
ধর্ম প্রচার:
শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি: ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত।
ধম্ম: নৈতিক আচরণ, সামাজিক সম্প্রীতি।
পতনের কারণ:
দুর্বল উত্তরাধিকারী: কুনাল ও দশরথ।
অর্থনৈতিক সংকট: প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি।
বহিঃআক্রমণ: গ্রিক ও শক আক্রমণ।
৬. গুপ্ত সাম্রাজ্য (৩২০–৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)
সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫–৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ):
"ভারতের নেপোলিয়ন":
দিগ্বিজয় অভিযান (প্রয়াগ প্রশস্তি)।
সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা:
কবি হরিষেণ ও বীণাবাদক।
চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (৩৭৫–৪১৫ খ্রিস্টাব্দ):
রাজ্য বিস্তার: শকদের পরাজিত করে পশ্চিম ভারতে আধিপত্য।
সাংস্কৃতিক উন্নতি:
কালিদাস: অভিজ্ঞানশকুন্তলম, মেঘদূত।
আর্যভট্ট: শূন্য ও দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কার।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়: গুপ্তযুগে প্রতিষ্ঠিত (পরবর্তীতে পাল রাজাদের দ্বারা উন্নত)।
৭. বাংলার পাল ও সেন বংশ
পাল বংশ (৮ম–১২শ শতক):
প্রতিষ্ঠাতা: গোপাল (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ)।
ধর্ম:
বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক (বিক্রমশীলা ও সোমপুর মহাবিহার)।
শাসন ব্যবস্থা:
মন্ত্রী পরিষদ: সামন্ত প্রথা।
সেন বংশ (১১শ–১২শ শতক):
প্রতিষ্ঠাতা: সামন্ত সেন।
ধর্ম:
হিন্দু ধর্ম (বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথা)।
সাংস্কৃতিক অবদান:
জয়দেব: গীতগোবিন্দ রচনা।