রাজনৈতিক বিজ্ঞানের আচরণবাদী পদ্ধতি (Behavioural Approach)

 


রাজনৈতিক বিজ্ঞানের আচরণবাদী পদ্ধতি (Behavioural Approach)

সংজ্ঞা:
আচরণবাদী পদ্ধতি হলো রাজনৈতিক বিজ্ঞানের একটি বৈজ্ঞানিক ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করে। এটি পরিমাপযোগ্য তথ্যপ্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ-এর উপর জোর দেয়।

আচরণবাদী পদ্ধতির মূল স্তম্ভ

১. ক্ষমতার ধারণা (Concept of Power)

ক্ষমতা হলো আচরণবাদী বিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় বিষয়। এটি শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কেরও প্রতিফলন।

বিশ্লেষণের মাত্রা:
✔ ব্যক্তিগত ক্ষমতা: নেতা বা রাজনীতিবিদের প্রভাব (যেমন—নরেন্দ্র মোদীর জনসমর্থন)।
✔ গোষ্ঠীগত ক্ষমতা: লবি, রাজনৈতিক দল বা শ্রেণীর প্রভাব (যেমন—কৃষক ইউনিয়নের আন্দোলন)।
✔ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা: সংবিধান, সরকার বা আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রয়োগ।

রবার্ট ডালের মতে:

"ক্ষমতা হলো 'ক'-কে 'খ'-এর বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করার সামর্থ্য।"

২. প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ (Process Analysis)

রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিভাবে গৃহীত হয়, তা বোঝার জন্য প্রক্রিয়াগত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

উদাহরণ:
✔ নির্বাচনী প্রক্রিয়া: ভোটারদের মনোভাব, প্রচার কৌশল, জরিপ।
✔ নীতি প্রণয়ন: সরকার কীভাবে একটি আইন পাস করে (যেমন—CAA বা কৃষি আইন)।
✔ সংঘাত ও সমাধান: শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্পোরেটের মধ্যে আলোচনা।

গুরুত্ব:

  • রাজনীতিকে গতিশীল ও বাস্তবসম্মতভাবে বোঝা যায়।

৩. পরিমাপ ও পরিমাণগত বিশ্লেষণ (Quantification)

আচরণবাদীরা সংখ্যাভিত্তিক ডেটা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ঘটনাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেন।

পদ্ধতি:
✔ জরিপ (Survey): ভোটারদের রায়, রাজনৈতিক পছন্দ।
✔ পরিসংখ্যান: নির্বাচনে দলের ভোট শতাংশ বিশ্লেষণ।
✔ গাণিতিক মডেল: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা বিপ্লবের পূর্বাভাস।

উদাহরণ:

  • লোকসভা নির্বাচনের এক্সিট পোল বিশ্লেষণ।

  • জিনি সহগ (Gini Coefficient) দ্বারা অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিমাপ।

আচরণবাদী পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য

  1. বিজ্ঞানসম্মত: পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও যাচাইযোগ্যতা।

  2. মূল্যনিরপেক্ষতা: গবেষক নিজস্ব মতামত থেকে দূরে থাকেন।

  3. আন্তঃশাস্ত্রীয়: সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক।

সমালোচনা

✔ মানবিক উপাদান উপেক্ষা: আবেগ, মূল্যবোধ বা নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে।
✔ ডেটার সীমাবদ্ধতা: সব রাজনৈতিক ঘটনা সংখ্যায় প্রকাশযোগ্য নয় (যেমন—সাংবিধানিক সংকট)।

ঐতিহ্যবাহী vs আচরণবাদী পদ্ধতি

বিষয়ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিআচরণবাদী পদ্ধতি
ফোকাসআদর্শ, প্রতিষ্ঠানব্যক্তির আচরণ, গোষ্ঠীগত প্রক্রিয়া
পদ্ধতিগুণগত (দর্শন, ইতিহাস)পরিমাণগত (জরিপ, পরিসংখ্যান)
উদাহরণ"রিপাবলিক" (প্লেটো)নির্বাচনী জরিপ (গ্যালাপ)                    

আচরণবাদের উত্তর-আচরণবাদী সমালোচনা (Post-Behavioural Critique of Behaviouralism)

ভূমিকা

১৯৬০-৭০-এর দশকে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের আচরণবাদী পদ্ধতির (Behavioural Approach) একটি বড় ধরনের সমালোচনা দেখা দেয়, যা উত্তর-আচরণবাদ (Post-Behaviouralism) নামে পরিচিত। এই সমালোচনার মূল নেতা ছিলেন ডেভিড ইস্টন, যিনি ১৯৬৯ সালে "The New Revolution in Political Science" প্রবন্ধে এই ধারণা উপস্থাপন করেন।


আচরণবাদের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলি

১. মূল্যবোধহীনতা (Value Neutrality)

  • আচরণবাদীরা দাবি করেন যে তারা মূল্যনিরপেক্ষ (Objective) গবেষণা করেন, কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কখনোই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হতে পারে না।

  • উত্তর-আচরণবাদীরা বলেন: "ফ্যাক্টস ও ভ্যালুজ আলাদা করা যায় না"

    • উদাহরণ: ভোটার জরিপে গবেষকের নিজস্ব পক্ষপাত থাকতে পারে।

২. অতিমাত্রায় পরিমাণনির্ভরতা (Over-Quantification)

  • আচরণবাদীরা পরিসংখ্যান ও গাণিতিক মডেল-এর উপর অত্যধিক জোর দেন, কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্ন সংখ্যায় মাপা যায় না।

    • যেমন: "ন্যায়" বা "স্বাধীনতা"-কে কীভাবে সংখ্যায় প্রকাশ করবেন?

৩. বাস্তব সমস্যা থেকে দূরে সরে যাওয়া (Irrelevance to Real-World Problems)

  • আচরণবাদীরা শুধু তাত্ত্বিক গবেষণা-তে মগ্ন থাকেন, কিন্তু সমাজের জরুরি সমস্যা (যেমন—দারিদ্র্য, যুদ্ধ, পরিবেশ) নিয়ে কাজ করেন না।

    • ইস্টনের বিখ্যাত উক্তি:

      "Knowledge for what? If not for action, then for whom?"
      (জ্ঞান কেন? যদি তা কাজে না লাগে, তবে কার জন্য?)

৪. রাজনীতিকে 'অ্যাকশন'-এর থেকে আলাদা করা

  • আচরণবাদীরা রাজনীতিকে শুধু পর্যবেক্ষণ করেন, কিন্তু পরিবর্তনের এজেন্ট (Agent of Change) হতে চান না।

  • উত্তর-আচরণবাদ বলছে: "গবেষকদের সমাজের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে"


উত্তর-আচরণবাদের মূল নীতিসমূহ

১. সমস্যা-ভিত্তিক গবেষণা (Problem-Oriented Research)

  • গবেষণা বাস্তব বিশ্বের সমস্যা-কে কেন্দ্র করে হওয়া উচিত (যেমন—জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার)।

২. মূল্যবোধের স্বীকৃতি (Acknowledgment of Values)

  • রাজনৈতিক বিজ্ঞানকে নৈতিক দায়িত্ব নিতে হবে (যেমন—গণতন্ত্র রক্ষা, সামাজিক ন্যায়)।

৩. তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় (Theory and Praxis)

  • শুধু ডেটা সংগ্রহ নয়, নীতি প্রণয়ন-এ সহায়তা করা প্রয়োজন।

৪. জরুরি অবস্থায় অ্যাকশন (Action in Crisis)

  • গবেষকদের সামাজিক আন্দোলন, নীতি বিশ্লেষণ ও গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।


উদাহরণ

আচরণবাদী পদ্ধতিউত্তর-আচরণবাদী সমালোচনা
ভোটার আচরণের পরিসংখ্যান সংগ্রহভোটারদের সমস্যা নিয়ে নীতি প্রস্তাব (যেমন—EVM হ্যাকিং রোধ)
ক্ষমতার গাণিতিক মডেল তৈরিক্ষমতার অপব্যবহার রোধে আইনি সংস্কার
রাজনৈতিক দলের কাঠামো বিশ্লেষণদলীয় অর্থপুষ্টি ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ



Post a Comment (0)
Previous Post Next Post